ওয়াহেদুজ্জামান দিপু | বুধবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২০ | পড়া হয়েছে 1964 বার
ফাইল ছবি
নারী উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা পেলেন উপজেলার লাউর ফতেহপুর ইউনিয়নের আহাম্মদপুর গ্রামের আব্দুল হান্নান সরকারে’র স্ত্রী খোশনাহার বেগম।
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জয়িতাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ সম্মাননা তুলে দেয়া হয়েছে।
বুধবার (০৯ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনির।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একরামুল ছিদ্দিক। এছাড়াও বিশেষ অতিথি ছিলেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সাদেক, ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলা) শিউলি রহমান।
সভায় আলোচকরা মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার বর্ণাঢ্য জীবনীর উপর আলোচনা করেন। নারীর অধিকার আদায়ে তারা বেগম রোকেয়ার পদাঙ্ক অনুসারণের তাগিদ দেন।
সভায় খোশনাহার বেগম ছাড়াও অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় আরো ৪ জন জয়ীতা নারীর হাতে ক্রেস্ট ও সম্মাননা তুলে দেন অতিথিরা।
খোশনাহার বেগম শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য থাকায় তার পক্ষে প্রধান অতিথি উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনিরের কাছ থেকে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট নেন তাঁর ছেলে ডা. মোহাম্মদ ইখতিয়ার উদ্দিন।
“মা” বাংলা বর্ণমালার মাত্র একটি বর্ণ দিয়ে গঠিত শব্দ; কিন্তু পৃথিবীর সকল মধুরতা যেন এই শব্দে গাঁথা, অমৃতের খনি, যার মাঝেই পৃথিবীর সকল তৃপ্তি। নশ্বর এই পৃথিবীতে সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মায়ের কোল।
একথা সত্যি যে, সন্তান ধারণ, জন্মদান কিংবা লালন পালনের সাথে একজন মায়ের শারীরিক বেদনার ইতিহাস আছে; আবার মা হওয়ার সুখ-তৃপ্তি-গর্ব ও আছে। আবার সেই সন্তানকে জগৎ সংসারে প্রতিষ্ঠিত করে অনেকের মধ্যে একজন করে তোলার কৃতিত্বও একজন মায়ের উপর বর্তায়। এমন একজন সফল মা হলেন “খোশনাহার বেগম”।
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন সনদ নেই কিন্তু মাতৃত্বের প্রশ্নে তাঁর সাথে জগতের কোন শিক্ষকের, পরামর্শকের, কোন চিকিৎসকের কিংবা অন্য কোন পথ প্রদর্শকের তুলনা চলে না।
খোশনাহার বেগম, ডাক নাম “খুকী” বর্তমানে ১১টি সফল সন্তানের জননী। তিনি ১৯৫৫ সালের ৯ অক্টোবর ব্রা²ণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম মিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কামলি পাশ পিতা মাওলানা আবদুল মান্নান চিশতি ছিলেন মুর্শিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক, মা আছয়িা খাতুন ছিলেন গৃহিনী।
এক ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। পারিবারিক সূত্রে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ তৈরী হয়েছিল। বাবা, চাচা সবাই-ই শিক্ষিত ও চাকুরীজীবী ছিলেন। বিশেষ করে পোস্টমাস্টার চাচার তত্ত¡াবধানে বাড়িতেই বাল্য শিক্ষার বই পড়ে ১৯৬৩ সালে মিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
এক চাচা স্কুল শিক্ষক হওয়ায় বাড়িতেই পড়ার ভাল পরিবেশ পেয়েছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণীতেই প্রথম স্থানের অধিকারী ছিলেন। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা ভাল-ই চলছিল। পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একটি মেয়েকে নবীনগর উপজেলায় যেতে হবে, সেটা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
এদিকে সকল অনুপ্রেরণার উৎস বড় চাচা ও বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে মারা যান। অনেক সম্ভবনাময় মেধাবী মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণীর পর গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় আর পড়াশোনা করতে পারেন নি। তাঁর বড় চাচার অনেক স্বপ্ন ছিল ভাতিজিকে শহরের নামি-দামি স্কুল কলেজে পড়াবেন। চাচার উৎসাহেই বড় হয়ে আইন বিষয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় নি।
ততদিন বড় চাচা বেঁচে থাকলে হয়তো খুকীর জীবনের গল্পটা অন্যরকম হতে পারত। ১৯৭২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে একই উপজেলার আহাম্মদপুর গ্রামের আব্দুল হান্নান সরকারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬৮ সাল থেকে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত সময়টাতে বাড়িতেই মুর্শিদাবাদ থেকে বাবার পাঠানো বিভিন্ন বই পড়তেন, মায়ের কাছ থেকে নঁকশীকাঁথা সেলাই, সুতা দিয়ে কারুকাজ করা, তালপাতার পাখা বানানো ইত্যাদি শিখেন।
বাবার বাড়িতে ঘর গৃহস্থালীর কাজ কখনো করতে হয় নি, কিন্তু কৃষক স্বামীর একান্নবর্তী পরিবারে তাঁকে দিন-রাত অনেক কাজ করতে হয়েছে। ধান মাড়াইসহ বাড়ির উঠোনে ফসলের কাজে পারদর্শী না হওয়ায় শাশুড়ী পাঁচ ছেলের বউয়ের মধ্যে তাঁকে বাড়ির রান্নার দায়িত্ব দেন।
যৌথ পরিবার তাই প্রতিবেলায় ৫০/৬০ জনের রান্না করতে হত, আস্তে আস্তে বাড়ির উঠানের ফসল প্রক্রিয়াকরণের কাজও শিখে ফেলেন। গ্রামীণ কৃষিনির্ভর পরিবারে অতি দরিদ্র্যতা ছিল না তবে টানাপোড়েন ছিল।
স্বাভাবিক প্রয়োজনে যখন একক সংসার শুরু করেন স্বামী ভাগে পেয়েছিলেন কয়েক বিঘা জমি আর একটি দু’চালা টনিরে ঘর। স্বামীও বেশী পড়াশোনা করতে পারেন নি, পড়েছেন দশম শ্রেণী পর্যন্ত। তবে, দু’জনেরই পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল।
পুরুদমে ঘর গৃহস্থির কাজ করেও এই মা তাঁর ১১টি সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। যেই মেয়েটি বাবার বাড়িতে কোন কাজই করেন নি, তাঁকে কৃষক স্বামীর সংসারে ৩০ বিঘা জমির ধান, গম, সরিষা সহ সারা বছরই বিভিন্ন ফসলের কাজ করতে হত।
ধানের মূল্য কম চালের মূল্য বেশী তাই সন্তানদের পড়াশোনার খরচ নির্বাহের জন্য এই মা সারা দিনের কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যায় সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে সারারাত কুপিতে আগুন জ্বালিয়ে ধান সিদ্ধ করতেন। প্রত্যন্ত গ্রাম বিদ্যুৎ তো কল্পনা মাত্র, তাই ফজরের আযান দিলে বুঝতেন এই বুঝি ভোর হচ্ছে। কৃষিনির্ভর পরিবার সারাবছরই কোন না কোন ফসলের মৌসুম থাকত।
সন্তানদের পড়াশোনা করানোর জন্য আলাদা সময় বের করা সম্ভব ছিল না, তাই সকালে তিনি যখন রান্না করতেন তখন নিজের বানানো চাটি বিছিয়ে রান্না ঘরে বসেই সন্তানদের পড়াতেন।১১টি সন্তানকেই এই মা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত নিজে পড়িয়েছেন। সময়কে গুরুত্ব দেওয়া, কঠোর পরিশ্রম করা, শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ-ই হয়ে উঠেছিল এই মায়ের জীবনের চালিকা শক্তি।
আর একটি কথা না বললেই নয়, এত কাজের ভীরওে তিনি সন্তানদের কঠোর নিয়ামনুবর্তিতার মধ্যে রাখতেন, নিজের কাজ কিভাবে করতে হয় তা শিখাতেন, এতগুলো ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করানোর জন্য তিনি কিছু কৌশল অবলম্বন করতেন- যেমন: বড় সন্তানদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ছোটদের পড়াশোনায় সাহায্য করতে, পড়া বুঝিয়ে দিতে, সন্তানদের নতুন বই গুলো পরম মমতায় মলাট লাগিয়ে বাঁধাই করে দিতেন, বইয়ের উপর রঙ্গিন কলম দিয়ে নাম, রোল, শ্রেণী, বিষয় ইত্যাদি লিখে দিতেন।
তিনি সেই মা যিনি সন্তানদের গণনা শিখাতেন নিজের লাগানো গাছের শিমের বিচি, লাউয়ের বিচি দিয়ে, তাঁর জন্য সন্তানদের শিক্ষা গ্রহন করানো কঠিন ছিল, গ্রামে শুধু একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, হাই স্কুল ছিল ৪ কিলোমিটার দূরে অন্য গ্রামে আর কলেজ ছিল উপজেলা সদরে যার দূরত্ব ছিল ১০ কিলোমিটার। আর বছরের প্রায় অর্ধেক সময় রাস্তাঘাট-যা-ই ছিল তা পানির নিচে তলিয়ে থাকত।
কোন বাঁধা ই এই মায়ের ইচ্ছা শক্তির কাছে টিকে থাকতে পারে নি। তাঁর ১১টি সন্তান-ই প্রাথমিকে বৃত্তি পেয়েছে। দেশে-বিদেশের নামী-দামী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর ১১টি সন্তান-ই কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা করেছে।
তিনি সেলাই এর কাজও জানেন, যা দেখতেন তা-ই শিখতেন। পুরাতন কাগজের সাথে ভাতের মার মিশিয়ে ঢেকিতে পিশে ঝুড়ি, খাঁচা সহ ব্যবহারের অনেক জিনিস বানাতেন। চাটি, পাটি, হাতপাখা, বসার মোড়া, নকশী কাঁথা সবই বানাতে জানেন এমনকি এখনো বানান। বাহারি সব পাখা বানিয়ে রেখেছেন- যেমন শঙ্খলতা, কলমিলতা, পুকুরকাটা, কদমফুল, ময়ূরপক্ষী ইত্যাদি।
সংসারের বাড়তি আয় ও সন্তানদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার জন্য তিনি নিজ উদ্যোগে ২০০/৩০০ মুরগী ৫০/১০০টা হাঁস লালন পালন করতেন আর গৃহস্থের ঘরে তো ৮/১০ টা গরু ছিল-ই। তাঁর হাঁস- মুরগী লালন পালনের নাম ডাক গ্রামে ছিল- সন্তানেরা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফি দেওয়ার জন্য ভাংতি টাকা দিতে গেলে শিক্ষকেরা বলতো ও বুঝছি তোর মায়ের ডিম বিক্রির টাকা।
তিনি একজন বৃক্ষপ্রেমী ও বলা যায়- এমনকি এখনো নিয়মিত গাছ লাগান। বাড়ির আঙ্গিনায় তিনি সব সময় সবজি চাষ করেন, অসংখ্য দেশীয় ফলের গাছ, কাঠ গাছ, তুলসী, বাসক, অর্জুনের মত ঔষধি গাছ ও রোপন করে রেখেছেন।
কঠোর পরিশ্রমী এই “মা” এখনো বেশীরভাগ সময় গ্রামে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, শখের হাতপাখা, শীলতপাটি বানান, নঁকশীকাঁথা সেলাই করেন। জীবনে কঠোর পরিশ্রম আর বয়সের ভারে ষাটোর্ধ্ব এই মা আজ সফল। তাঁর চোখে মুখে আলোর ঝিলিক, তৃপ্তির হাসি- তাঁর ১১টি সন্তান-ই মহান আল্লাহ তালার অশেষ রহমতে সুশিক্ষিত হয়েছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেও তিনি তাঁর চার মেয়ের দুইজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একজনকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকজনকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন।
খোশনাহার বেগমে’র সন্তানদের বর্তমান অবস্থান
তথ্য সহযোগীতায়ঃ
(আসমা জাহান সরকার, ৭ম সন্তান)
সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, কুমিল্লা।
মোবাইল: ০১৭৫৯-৭৭৬৬৭২